বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। পর্যটন জেলা কক্সবাজারের একটি উপজেলা। পুরো দ্বীপটাই সাগরবেষ্টিত। এই উপজেলার মধ্যেই অবস্থিত সোনাদিয়া দ্বীপ। কাছাকাছি মাতারবাড়ী। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ এই দ্বীপের ভাগ্য খুলে গেছে। আধুনিক একটি শিল্পাঞ্চলে রূপ নিতে যাচ্ছে দ্বীপটি। আগামী ১০ বছরে এই মহেশখালী এনার্জি হাবে পরিণত হবে। লক্ষাধিক কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে এ উপজেলায়।
এরই মধ্যে এ দ্বীপকে কেন্দ্র করে ১০ থেকে ১৫টি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেগুলো আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে বাস্তবায়নের কথা। এর মধ্যে রয়েছে ছয়টি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র, তিনটি এলএনজি টার্মিনাল ও চারটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ ছাড়া সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। জ্বালানি তেল পরিবহনে করা হচ্ছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল। কয়লা খালাসের জন্যও বড় টার্মিনাল হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সঞ্চালন, রাস্তাঘাট, আবাসনসহ নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করছে সরকার। অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগোর মতে,
১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দের প্রচ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই মহেশখালী দ্বীপের সৃষ্টি। একজন পর্তুগিজ ভ্রমণকারী আরাকান অঞ্চলে এই প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তা ছাড়া দ্বীপের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে উত্তর-দক্ষিণমুখী পাহাড় এবং তার পাদদেশে প্রবাহিত চ্যানেল থাকার কারণে ধারণা করা হয়, দ্বীপটি একসময় মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। মহেশখালী উপজেলা আরও তিনটি ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলো হলো_ সোনাদিয়া, মাতারবাড়ী ও ধলঘাটা।
মহেশখালী দ্বীপের আয়তন ৩৬২ দশমিক ১৮ বর্গকিলোমিটার। কক্সবাজার থেকে দ্বীপটির দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। উপজেলার উত্তর-পূর্বে চকরিয়া উপজেলা, দক্ষিণ-পূর্বে কক্সবাজার সদর, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর, উত্তর-পশ্চিমে কুতুবদিয়া উপজেলা। উপজেলার উত্তর-দক্ষিণমুখী মহেশখালী চ্যানেল দ্বারা মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
দেশে গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে আসছে। সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে মনোযোগ দিয়েছে। কয়লা জাহাজে করে আমদানি করতে হবে। ফলে সাগর উপকূলই হলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উপযুক্ত জায়গা। এ ছাড়া এলএনজিও আমদানি করতে হবে সাগরপথে। কারণ, সারাদেশে গ্যাসভিত্তিক যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে, সেগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এসব বিবেচনায় সরকার এই মহেশখালী দ্বীপটি বেছে নিয়েছে। ফলে সরকারের কাছে মহেশখালী দ্বীপটি এখন স্বর্ণখনি। আগামী কয়েক বছরেই এ দ্বীপ বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পশহরে পরিণত হবে।
সরকারের পরিকল্পনা যদি যথাসময়ে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে মহেশখালীতে আগামী ১০ বছরের মধ্যে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। সবক’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে ‘মেগা সাইজ’, অর্থাৎ বড় কেন্দ্র।
বিদ্যুৎকেন্দ্র :বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। এতে ব্যয় হবে প্রায় ২০০ কোটি ডলার, অর্থাৎ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মালয়েশিয়ার সঙ্গে যৌথ মূলধনি কোম্পানি গঠন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তেনেগা ন্যাশনাল বারহেড এবং পাওয়ারটেক বারহেডের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে পিডিবির এই চুক্তি হতে যাচ্ছে। মহেশখালীতে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ হাবে কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে সমান অংশীদারিত্ব থাকবে বলে পিডিবি জানিয়েছে। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য সম্প্রতি পিডিবি ওই এলাকায় জমিও অধিগ্রহণ করছে।
মহেশখালীতে আরও একটি ৭০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি ডলার, অর্থাৎ ১০ হাজার কোটি টাকা।
এ ছাড়া আরও একটি এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এটা করা হবে সরকার ও এডিবির অর্থায়নে। এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০০ কোটি ডলার। আরও কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে এখানে।
এলএনজি টার্মিনাল :মহেশখালীর উপকূলে করা হচ্ছে একটি এলএনজি (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) টার্মিনাল। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিদিন ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস এখান থেকে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে দেওয়া হবে। ২০১৮ সালের মধ্যেই জাতীয় গ্রিডে এই গ্যাস দেওয়ার কথা। পরবর্তীকালে প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়ার সক্ষমতা থাকবে এই টার্মিনালের। এ ছাড়া ভারতের শিল্প গ্রুপ রিলায়েন্স এখানে একটি এলএনজি টার্মিনাল করার প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার প্রাথমিকভাবে সেটির অনুমোদনও দিয়েছে। রিলায়েন্স বাংলাদেশে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে। ওই গ্যাস দিয়ে তারা এই বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে চায়। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বড় বেসরকারি কোম্পানি সামিট গ্রুপ মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্য গত মাসে প্রস্তাব দিয়েছে। এ তিনটি এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হতে পারে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা ৩২০ কোটি ঘনফুট। সেখানে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ কোটি ঘনফুট। ৫০ কোটি ঘনফুট ঘাটতি। এ চাহিদা আরও বাড়বে। এ জন্য গ্যাসের চাহিদা মেটাতে দেশের প্রথম এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এসপিএম প্রকল্প :সমুদ্রের জাহাজ থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরাসরি ইআরএল (ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড) পর্যন্ত জ্বালানি তেল সরবরাহে নেওয়া হয়েছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল (এসপিএম) প্রকল্প। ডাবল পাইপলাইনসহ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে চার হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা।
এসপিএম টার্মিনাল নির্মাণের পর লাইটারেজ অপারেশনের মাধ্যমে ত্রুক্রড তেল ও ফিনিশড পেট্রোলিয়াম প্রডাক্ট আমদানির ক্ষেত্রে সিস্টেম লস কমানো যাবে এবং দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে। আবার আমদানি করা ত্রুক্রড তেল এবং ফিনিশড প্রডাক্ট সহজে, নিরাপদে, অপেক্ষাকৃত কম খরচে ও স্বল্প সময়ে খালাস করা যাবে।
বিশেষায়িত অঞ্চল :মহেশখালীতে চারটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কক্সবাজার সদর থেকে সড়কপথে ৪০ কিলোমিটার ও নৌপথে চার কিলোমিটার দূরে মহেশখালী উপজেলার ছোট মহেশখালী, পাহাড় ঠাকুরতলা ও গোরকঘাটা মৌজাজুড়ে এক হাজার ৪৩৮ একর এলাকায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর নাম মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল-১। মহেশখালীর উত্তর নলবিলা মৌজার ৮২৭ একর জমিজুড়ে মহেশখালী অর্থনৈতিক অঞ্চল-২ নামে আরেকটি অঞ্চল প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এলাকাটি মহেশখালী চ্যানেলের পাড়ে ও বদরখালী সেতু দ্বারা সারাদেশের সড়ক সংযোগের সঙ্গে যুক্ত। মহেশখালীর ধলঘাটা মৌজার ৬৭৬ একর এলাকাজুড়ে মহেশখালী-৩ নামে আরও একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনটি অঞ্চলেই যথাক্রমে মহেশখালী ও মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া যাবে। দেশের দুই সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এর নৌ যোগাযোগও ভালো। পাশাপাশি জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বসতি বা আবাদি জমি নষ্ট করতে হবে না।
সোনাদিয়া :কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের অধীনে সোনাদিয়া দ্বীপের অবস্থান। এটি কক্সবাজার থেকে সাড়ে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। দ্বীপের মোট আয়তন ২০ বর্গকিলোমিটার এবং মোট জমির পরিমাণ দুই হাজার ৯৬৫ দশমিক ৩৭ একর। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি ৩ দশমিক ১৫ একর এবং সরকারের ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত জমি দুই হাজার ৯৬২ দশমিক ২২ একর। এই সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এ ছাড়া মাতারবাড়ী ইউনিয়নকে একটি অত্যাধুনিক টাউনশিপ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। পাশাপাশি মাতারবাড়ীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল, কয়লা আমদানির জন্য জেটি নির্মাণ, মাতারবাড়ী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন, কক্সবাজার থেকে মাতারবাড়ী পর্যন্ত সমুদ্রের ওপর সেতু নির্মাণ করা হবে।
সরকারের এ উদ্যোগ খুব ভালো হলেও এটি বাস্তবায়নে তেমন কোনো গবেষণা করা হয়েছে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ইজাজ হোসেন সমকালকে বলেন, এর পেছনে যতটা শ্রম এবং গবেষণা করা দরকার, সেটা করা হয়নি। কীভাবে সেখানে এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করা হবে, সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়। ফলে এ বিষয়ে সরকারকে এখনই সতর্ক হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, সরকার সুপরিকল্পনার মাধ্যমে মহেশখালী দ্বীপকে এনার্জি হাব হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে কমপক্ষে ১০ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ জন্য সাগরপথে বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করতে অত্যাধুনিক জেটি তৈরি করা হবে। এখানে কয়েকটি এলএনজি টার্মিনাল হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, মহেশখালীর মাতারবাড়ীকে সিঙ্গাপুুরের আদলে একটি অত্যাধুনিক পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এ জন্য ৩৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জাপান, চীন, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মহেশখালীতে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মহেশখালীকে বেছে নেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখানকার প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য জলপথে কয়লা সরবরাহ সহজ হবে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত খাসজমি রয়েছে এ দ্বীপে, জনবসতিও কম। সবকিছু বিবেচনায় মহেশখালী এনার্জি হাবের জন্য উপযুক্ত স্থান বলে মন্তব্য করেন তিনি। সমকাল
পাঠকের মতামত: